বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় দ্রুত, সহজে এবং স্বল্পখরচে নিরাপদ টিকাপ্রাপ্তির সব পথ খোলা রাখছে বাংলাদেশ। কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। দ্রুত টিকা পেতে পরীক্ষার শেষ ধাপে থাকা সব উদ্যোগের সঙ্গেই নিবিড় যোগাযোগ রাখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে আছে এমন ৬ দেশ চীন, ভারত, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। যেসব দেশের টিকা পরীক্ষার সব ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সেসব টিকা যেন বাংলাদেশেও উৎপাদন করা যায় সরকারের তরফ থেকে সে প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
ইতোমধ্যে টিকা বাজারে আনার ঘোষণা দেওয়া রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানানো হয়েছে। তা ছাড়া রাশিয়ার বাংলাদেশ মিশন টিকাপ্রাপ্তির একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে ঢাকায় পাঠিয়েছে। ওই প্রস্তাবে টিকাপ্রাপ্তির দুটি সম্ভাব্যতার কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে সরাসরি রাশিয়া থেকে টিকা আমদানি করা। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার টিকা বাংলাদেশি কোনো কোম্পানির মাধ্যমে দেশে উৎপাদন করা। কিন্তু ঢাকা থেকে এখনো সে প্রস্তাবনার বিষয়ে কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।
চীনসহ যেসব দেশে টিকা ট্রায়ালে রয়েছে, সেগুলো সফল হলে বাংলাদেশ কীভাবে তা সহজে এবং স্বল্পমূল্যে পেতে পারে- এ জন্য ইতোমধ্যে একটি রোডম্যাপও প্রণয়ন করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আলোচনার পর সম্প্রতি চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে সরকার। গত মাসেই অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটি অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০২টি গবেষণা চলছে করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে। তার মধ্যে ৮টি টিকার গবেষণা রয়েছে তৃতীয় ধাপে, যার মধ্যে চার থেকে পাঁচটিকে টিকা হিসেবে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রায় ৩০টির মতো রয়েছে প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে। সব মিলিয়ে করোনা মহামারী মোকাবিলায় ৯ ধরনের টিকা নিয়ে কাজ হচ্ছে, যার মধ্যে ছয় ধরনের টিকা বিশ্বের ইতিহাসে এবারই প্রথম। এ ছয় টেকনিকের টিকা পৃথিবীতে এখনো নেই। বাংলাদেশ টিকার আবেদন করেছে গত জুলাই মাসে। চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে টিকার কাজ অ্যাডভান্সড স্টেজে রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বিশ্বে ১৪১টি টিকা (ভ্যাকসিন) ডেভেলপ হয়েছে। হিউম্যান ট্রায়াল বা শেষ ও তৃতীয় ধাপে রয়েছে ২৫টি টিকা (ভ্যাকসিন)। এর মধ্যে থার্ড ফেজের ট্রায়ালে রয়েছে চীনের তিনটি, অক্সফোর্ডের একটি, মডার্নার একটি ও ফাইজারের একটি। সবকিছু নির্ভর করছে তৃতীয় ধাপে মানবদেহে পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলের ওপর।
সূত্র জানায়, বিশ্বে ৬০টি দেশ রয়েছে, যারা টাকা দিয়ে টিকা কিনবে। আর ৯২টি দেশ রয়েছে যারা বিনাপয়সায় পাবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। তাই বাংলাদেশ কবে পাবে বা কার টিকা আগে পেতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সরকার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে এগিয়ে থাকা সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও করোনা ভাইরাস সেলের প্রধান সমন্বয়ক ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমরা বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় দুভাবেই যোগাযোগ রাখছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট ঘোষণা, বাংলাদেশের সবাই করোনার টিকা পাবে। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। তা ছাড়া পরীক্ষার শেষ ধাপে থাকা দেশেগুলোকে কাঁচামাল, ফর্মুলাপ্রাপ্তির জন্য চিঠি দিয়েছি। যদি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় এবং মানবদেহে নিরাপদ প্রমাণিত হয়- তা হলে দেশেই যেন টিকা উৎপাদন করতে পারি। আমাদের দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সে সক্ষমতা রয়েছে। আর টিকা যদি দেশে উৎপাদন করতে পারি, তা হলে আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশ টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সব পথ খোলা রাখছে। বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে বলে মনে হচ্ছে। চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইসিডিডিআর,বি এ ট্রায়াল করবে। অনেক দেশ তো ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে, সেগুলো যদি ট্রায়াল দিতে চায়, তাদেরও অনুমতি দিতে পারে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর কিনা। আগামী পাঁচ মাস পর্যন্ত বোঝা যাবে না, কোন ভ্যাকসিন আগে আসবে। যেটা আবিষ্কার হবে- তার মধ্যে কোনটা বাংলাদেশে আসবে সেটা একটা ব্যাপার। তার পরের প্রশ্ন হচ্ছে- বাংলাদেশে সেই ভ্যাকসিন কী পরিমাণে আসবে এবং সেটা পয়সাতে আসবে নাকি বিনাপয়সায় আসবে সেটা দেখার বিষয়।
Leave a Reply